দার্শনিকের মতো ওয়ালীউল্লাহরও জীবনের দিকে সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে জীবন ও মৃত্যু যৌথভাবে তাঁর ভিতরে দেখা দিয়েছিলো সত্যরুপে। তবে মৃত্যু চেতনায়ই আচ্ছন্ন ছিলো তাঁর চেতনা। এ চেতনা রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও খুব বেশি লক্ষণীয়। তাঁর সমগ্র সাহিত্যের মৃত্যুর প্রবল উপস্থিতি। তাঁর জীবন ও মৃত্যুর দর্শনঃ জীবন মৃত্যু দু’টিই সে অতি সহজে গ্রহণ করে। আলো–অন্ধকারের মতো জীবন এবং মৃত্যু পাশাপাশি বসবাস করে। একই নদীতে মিলিত দু’টি ধারার মতো গলাগলি হয়ে প্রবাহিত হয়, দু’টিই বিনা বাক্যে গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় তার কাছে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চট্টগ্রামের ষোলশহরে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্য চর্চার ও ছবি আঁকার ঝোঁকছিল শৈশব থেকেই। তাঁর একটি ছোট গল্প ছাপা হয় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বার্ষিকীতে ১৯৩৯ সালে। গল্পটির নাম ‘সীমাহীন এক নিমেষে।’ তাঁর সাহিত্য জীবনের ভিত্তি যে কত মজবুত গল্পটি তাঁরই সাক্ষ্য শুরুটি এ রকম:
“বৃহৎ জানালাটা খোলা।
ঝোড়ো হাওয়া ঝাপটা মারছে আমার সারা দেহে।
খোলা জানালা দিয়ে ঢুকছে যে হাওয়া–উদ্দাম মুক্তির নিঃশ্বাস নিয়ে। বন্ধন হীন হাওয়া ছুটছে জোরে কঠিন তীব্র হ’য়ে–জুঁই ফুলের শুভ্র কোমলতা গুড়িয়ে দিয়ে তুলোর মত উড়িয়ে নিয়ে।
লতিয়ে আছি বিছানায়, ওরা কোমলতার সাথে দেহের উষ্ণ কোমলতা মিশিয়ে। নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছি ভোরের উন্মত্ত আকুল আহ্বানের মাঝে, যেখানে তার লজ্জানম্র অরুণ পরশ বিলীন হয়ে গিয়েছে।
দূরে দীর্ঘ ঝাউ গাছগুলোতে অবিশ্রাম মর্মর ধ্বনি। বহু নিপীড়িতের করুণ মর্মভেদী আর্তনাদের মত। বৃহৎ গাছগুলো অধীরভাবে দুলছে, আর সেই সঙ্গে দুলছে আমার হৃদয়। চোখ বুঝে আছি পরম তৃপ্তিতে। (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য ২য় খণ্ড)
সাহিত্য জীবনের শুরুতে কবিতার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিলো। কিছু কবিতাও লিখেছিলেন। মৃত্তিকায় প্রকাশিত ‘তুমি’ কবিতাটি তাৎপর্যপূর্ণ। এটির বিষয়বস্তু মানব প্রকৃতি।
তুমি যখন হাসো, তখন মনে হয় যেন
কাকাবুরা তার বিচিত্র হাসি হাসছে,
আর কাঁদো যখন তখন মনে হয়,
আস্ত ধাড়ি একটা সিম্পাঞ্জী বুঝি কাঁদছে।
তোমার মনে সন্দেহের মেঘ ঘনিয়ে এলে
জিরাফের মতো গলা উঁচিয়ে
তুমি তাকাও এধার ওধার।
এবং কোনো হীন কাজে ধরা পড়ে গেলে
তুমি কচ্ছপের মতো হঠাৎ
তোমার মাথাটি গুটিয়ে আনো,
মাথাটি গুটিয়ে আনো
আর ছাগলের মতো উদাসীন করে তোলো তোমার চোখ।
জীবনের নিঃসঙ্গতাকে তিনি ভরে তোলেছিলেন অধ্যায়নও শিল্পচর্চা করে। চিত্রশিল্প সম্পর্কে লিখেছেন কয়েকটা প্রবন্ধ, সেগুলোর প্রায় সবই ইংরেজীতে।
অন্যায়–অবিচার ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক্কালে হইলাম ধর্ম ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলো এবং বহু শতাব্দী পর মার্কসবাদী চিন্তাধারা অর্থনৈতিক দূরকরতে যে আয়োজন শুরু করে রুশ বিপ্লবের পর পৃথিবীর দেশে দেশে সে সম্পর্কে ইতিহাসবিদ আরনল্ড টোয়েনবি–র মতো ওয়ালীউল্লাহকেও বলতে শোনা যায়।…
আরেক কথা মনে রাখতে হবে। আজ পর্যন্ত অধিকাংশ মনীষী পৃথিবীর বুকে জন্মগ্রহণ করে মানবের জন্য যে যে বাণী এনেছেন, তাদের প্রায়গুলো ব্যর্থ হয়েছে বাস্তবে এই কারণে যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় সে সব মনীষীর মতো উচ্চস্তরে ওঠা। একমাত্র আমাদের মুহম্মদ (দঃ) ও কার্ল মার্কস ছাড়া মানবের জন্যে গোটা মানবের জন্যে আর কেউ সম্ভবপর ও বাস্তবিক বাণী দিতে পারেন নি।
তাঁর সাহিত্যে অশিক্ষিত গেঁয়ো মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন হঠাৎ কবিতা হয়ে’ ওঠেছে। আবার মধ্যবিত্ত সমাজের ভেতরের অন্তর্জরতা দৈন্য ও কুপ্রীতা নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। জীবনের অনেক বাস্তবতাই তাঁর ‘আদর্শবাদী মনকে কঠিনভাবে আঘাত করেছে। তাঁর স্বাক্ষর উপন্যাস ও ছোটগল্পসমূহ। শুধু শিল্প হিসেবেও নয়, বাংলাদেশও বাঙালির বাইরের এবং অন্তর জীবনকে জানার জন্যে বাংলা ছোটগল্প একটি অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর ছোটগল্পে ব্যক্তি ও সমাজ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাঁর অনেক গল্পের পটভূমি, ছিল সমাজ। সমাজের সমস্যার মতোই ব্যক্তির অন্তর্জগতের সমস্যাও উপেক্ষনীয় নয়। ওয়ালীউল্লাহ ব্যক্তির সেই অন্তরপুরের ছবি আঁকতে চেয়েছেন উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও।
তাঁর অনবদ্য একগল্প ‘নয়নচারা’। নয়নচারা একটি গ্রামের নাম। যে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ময়ুরাক্ষী নদী। সেই নদী পাড়ের গ্রাম থেকে দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত বহু লোক এসেছে কলকাতা মহানগরে দু’টি ভাতের আশায়। সেই ছিন্নমূল মানুষদের একজন আমু তার নষ্টালজিয়া, স্মৃতিচারণ এবং তাদের সকলের নির্মম গাথা ‘নয়নচারা’। ভাত–মাছ স্নেহ মায়ামমতার প্রতীক হয়ে ওঠে নয়নচারা–বাংলাদেশের প্রতিভূ–গ্রামে পরিণত হয়। পথের ওপর শুয়ে শুয়ে আমুর ঘনায়মান কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ুরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে। এই গল্পটি ১৩৫০–এর মন্বন্তরের দুর্ভিক্ষ ও দুঃখের বাস্তবচিত্র। নিরন্ন কংকালসার মানুষগুলো মহানগরীর পথে পথে দ্বারে দ্বারে দিনরাত ঘুরছে। ‘মা গো, চাট্টি খেতে দাও-’ আহবান ‘ঘুমন্ত বাড়িগুলোর গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে’ আসে আমুর নিজেরই গায়ে। অনাহার ক্লিষ্ট মানুষদের মনস্তত্ব তোলে ধরেছেন লেখক তাঁর নিজের ভাষায়। তারপর :
মৃত্যু যাত্রা শুরু হয়েছে। তাদের সে যাত্রা আসায় দোলায়িত, অথচ নিরাশায় জর্জরিত। চলার পথ ধূলিধূসর, নিষ্ঠুরতায় রুক্ষ, আর যেন অন্তহীন, প্রতিটি মুহূর্ত বেরিয়ে আসছে অজানার কালো গহ্বর হতে, এবং বেরিয়ে আসছে একঘেয়ে বৈরিতায়। তবু নিঃশ্বব্দ পথগুলো নীরব চলছে ধ্বংসের পানে।
ওয়ালীউল্লাহর কথা শিল্পের দার্শনিক উপাদান এবং মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার বিশ্লেষণ তাকে করেছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। সর্বোপরি তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘অগ্রগামী কথা শিল্পী।’ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’। গ্রামীণ মুসলমান সমাজের মানসিকতার এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব। পূণ্যবান পুরুষদের সমাধি শিলায় শ্রদ্ধা প্রদর্শন শুধু মুসলমান সমাজে নয়, বহু সম্প্রদায় এবং নানা জাতির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। উপন্যাসের কাহিনীটি একটি মাজার কেন্দ্রিক। শ্রাবণের দুপুরে গ্রামবাসী দেখে, মতিগঞ্জের সড়কের ওপরেই একটি লোক আকাশের পানে হাত তোলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির নাম মজিদ। এভাবেই মহব্বত গ্রামে তার প্রবেশ হলো। তার আগমনটা চমকপ্রদ। গ্রাম থেকে একটু বাইরে একটা বৃহৎ বাঁশঝাড়। …তারই একধারে এক প্রাচীন কবর। মজিদ নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করে যে ওটি ‘মোদাচ্ছের পীরের মাজার।’ ঝালওয়ালা সালু দ্বারা আবৃত হলো মাছের পিঠের মত সে কবর। ‘আগর বাতি গন্ধ ছড়াতে লাগলো, মোমবাতি জ্বলতে লাগলো রাতদিন।’… অহরহ লোকের সমাগম। তার সঙ্গে পয়সা ঝকঝকে পয়সা, ঘষা পয়সা, সিকি দুয়ানি আধুলি, সাচ্চা টাকা, নকল টাকা ছড়াছড়ি যেতে লাগলো। নিরাকপড়া শ্রাবণের সেই হাওয়া শূন্য স্তব্ধ দিনে তার জীবনে যে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল সালু কাপড়ে আবৃত্ত নশ্বর জীবনের প্রতীকটির পাশে যে জীবন এগিয়ে চললো’… অনেক দিন থেকে আলি ঝালি একটা চওড়া বেওয়া মেয়েকে দেখেছিলেন। মেয়েটির নাম রহিমা। …শেষে সেই প্রশস্ত ব্যাপ্ত যৌবনা মেয়ে লোকটিই বিবি হয়ে তার ঘরে এলো। এভাবে শুরু হয়েছে মাজার এবং মজিদের কাহিনী। দশ বারো বছর আগে যখন মজিদ মহব্বত নগর গ্রামে প্রবেশ করে তখন সে ছির ভাগ্যান্বেষী দুস্থ মানুষ, কিন্তু আজ সে জোত জমি সম্মান প্রতিপত্তির মালিক। তবে মাঝে মাঝে তারও মনে হয়: কার কবর এটা? যদিও মসজিদের সমৃদ্ধির যশমান ও আর্থিক সচ্ছলতার মূল কারণ এই কবরই। কিন্তু সে জানে না কে চিরঘুমে শায়িত এরতলে। পরবর্তীতে সন্তানপ্রাপ্তির অজু হাতে জমিলা নামে এক কিশোরীকে বিয়ে করে আনে মসজিদ। জমিলাকে পেয়ে রহিমার মনে শাশুড়ির ভাব জাগে। জমিলা ভাবিয়ে তোলে মজিদকে। ঠিকমত নামাজ পড়া হয় না। জমিলা কখনো হি হি করে হাসে, কখনও গুম মেরে বসে থাকে। তার বিন্দুমাত্র খোদার ভয় নেই। অত্যন্ত পৈশাচিক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ ভঙ্গিতে মজিদ দড়ি দিয়ে কাছাকাছি একটা খুঁটির সঙ্গে জমিলার কোমর বাঁধলো। মাঝখানের দড়িটা খোলা রাখলো, যাতে সে মাজারের পাশেই বসে থাকতে পারে’। হঠাৎ শুরু হলো ভয়াবহ ঝড় ও শিলাবৃষ্টি। ঝাপটা খোলে মজিদ দেখলো মেহেদী দেওয়া তার একটা পা কবরের সঙ্গে লেগে আছে। সংজ্ঞাহীন জমিলাকে শুইয়ে দিয়ে মাঠের দিকে হাঁটতে শুরু করে মজিদ।
সামনে ক্ষেতে ক্ষেতে ব্যাপ্ত হয়ে আছে ঝ’রে পড়া ধানের ধ্বংসস্তূপ। তাই দেখে চেয়ে চেয়ে। চোখে ভাব নেই। বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে চোখ।
‘মাছের পিঠের মতো চিরনীরব মাজারটি ‘বাঙালি মুসলমানের নিস্তরঙ্গ, নিশ্চেতন ও অনড় সমাজেরই প্রতীক। উপন্যাসের সমাপ্তিও প্রতীকী। জমিলা বিদ্রোহীনির প্রতীক। তার বিদ্রোহ নীরব ও নিঃশব্দ।
চাঁদের অমাবস্যা এবং কাঁদো নদী কাঁদো পূর্ব বাংলার গ্রামের মানুষেরই গল্প, কিন্তু রচনার সকল দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় গ্রামীণ পটভূমিতে প্রণীত বাংলা ভাষার সকল উপন্যাস থেকে এগুলো পৃথক। ওয়ালীউল্লাহ তাঁর প্রথম নাটক বহিপীর এও সমাজদেহের একটি বিশেষ রোগাক্রান্ত অংশের প্রতি অঙ্গলি নির্দেশ করেছেন। একদিকে বহিপীরের পলাতক বিবিকে নিয়ে সমস্যা, অপরদিকে জমিদার হাতেম আলীর সমস্যাও জটিল। হাতেম আলীর জমিদারী সান্ধ্যা আইনে পড়ে নিলাম ওঠবে। বহিপীরের পীড়া পীড়িতে হাতেম আলী তাঁকে সব খোলে বলেন:
হাতেম আলী : আমার আশা ছিলো আমি কোনো প্রকারে যথেষ্ট টাকা জোগাড় করতে পারবো, সে আশা নিয়েই আমি শহরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার বন্ধু আনোয়ার উদ্দিন আমাকে সাহায্য করবেন। সেখানে আমাকে নিরাশ হতে হলো।
বহিপীর : আহা জমিদার সাহেব, এতো বেচইন হইয়া পড়িবেন না, খোদার উপর তোয়াক্কাল রাখুন। দুনিয়া এক মস্ত পরীক্ষা ক্ষেত্র। খোদা কাহাকে কীভাবে পরীক্ষা করেন, তাহা বুঝিবার ক্ষমতা আমাদের নাই।
জমিদারের এই বিপদগ্রস্ত অবস্থা ধূর্ত বহিপীরের কাছে আশীর্বাদরূপে দেখা দেয়। তাহরো বিবি নামে একটি বালিকার সঙ্গে তাঁর শাদি মোবারক সম্পন্ন হয় এবং জমিদারকেও আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘আপনার সমস্যারও সমাধান হইবে।’ নানা আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বলার পর বহিপীর হাতেম আলীকে বলেন ;
বহিপীর : ঠিক আপনার জমিদারী যাইবে না।
হাতেম আলী : (যেন অলৌকিক দৃশ্য দেখেছেন) একি কথা বলছেন পীর সাহেব। সে কী করে সম্ভব?
বহিপীর : সম্ভব, সম্ভব। দেখুন আপনি শহরে আসিয়াছিলেন টাকা কর্জ করিতে, কিন্তু মনস্কামনা পূর্ণ হয় নাই, আপনার চেষ্টা সফল হয় নাই, কিন্তু জমিদারী যাওয়া না যাওয়া কেবল টাকার উপরই নির্ভর করিতেছে। সে টাকা আমি আপনাকে কর্জ দিব।
হাতেম আলী : পীর সাহেব।
বহিপীর : … এই শহরেই আমার জন্য তিনেক ধনী মুরিদ আছেন। তাঁহাদের কাছে চাহিলেই পাইব। তবে একটা শর্তে আপনাকে টাকা কর্জ দিব। তাহেরা বিবিকে আমার সঙ্গে ফিরিয়া যাইতে হইবে।
বহিপীরের খবর নিয়ে হাতেম আলী তাহেরা, হাশেম ও খোদেজাকে তা জানান। তাহেরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে,
পীর সাহেব যা চান তাই হবে। তাঁকে বলুন, আপনাকে টাকা দিলে তাঁর সঙ্গে আমি ফিরে যাবো। আগে তাঁকে টাকা দিতে হবে, তারপর আমি যাবো।
তাহেরার এই সম্মতি নিয়ে হাতেম আলী বহিপীর সাহেবের কাছে ফিরে আসেন।
বহিপীর : কী খবর জমিদার সাহেব?
হাতেম আলী : তিনি যাবেন।
বহিপীর : শোকর আল্হামদুলিল্লাহ।
হাতেম আলী : (বাধা দিয়ে) কিন্তু একটা কথা আছে। তিনি রাজী আছেন, আমি রাজী নই। আমি এভাবে টাকা নিতে পারবো না। যায় যাক জমিদারী।
বহিপীর : ভাবিয়া কথা বলিতেছেন কি?
হাতেম আলী : অনেক তো ভেবেছি, একদিনও ভাবতে ভাবতে শরীরের আর কিছুই নাই।
হাতেম আলীর সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ ও পরাজিত বহিপীর বলেন : (ঘন ঘন মাথা নেড়ে) হুঁ, বেশ বলিয়াছেন, উত্তম কথা বলিয়াছেন। হুঁ উত্তম কথা, অতি উত্তম কথা।
নাটক এগিয়ে গেছে আরো একটু। প্রতিক্রিয়া শীল ও পরাজিত বহিপীর তাহেরাকে না পেয়েও হাতেম আলীকে টাকা ধার দিতে সম্মত হন, কারণ জমিদারী রক্ষা করা তাঁর স্বার্থের জন্যে প্রয়োজন। সামাজিক সমস্যা ও পুরনো মূল্যবোধ সংক্রান্ত এই নাটকটির প্রতিটি চরিত্রই বিকশিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পীরের সন্দেহ পরায়ণতা ও সংকীর্ণচিত্ততা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন নাট্যকার। বহিপীর নিজের বিবি রক্ষার চেয়ে অন্যের জমিদারী রক্ষা বেশি জরুরি মনে করেন। পীরের লোভ, কপটতা সবই সূক্ষ্মভাবে উন্মোচিত হয়েছে। লালসালুতে জমিলার পা অনিচ্ছাকৃত মাজরের গায়ে লাগে, কিন্তু বহিপীর এ তাহেরা ইচ্ছাকৃতভাবে পদাঘাত করেছে পীর মোল্লা কবলিত সনাতন সমাজকে এ বিদ্রোহ প্রচন্ড।
তরঙ্গ ভঙ্গতে দেখা যায় দুস্থ আমেনা তার কোলের শিশু সন্তানকে স্তন্য দিতে অপারগ হওয়ায় তাকে গ্রামের বাইরে এক জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গলা টিপে মেরে ফেলে। ঐ পথ দিয়ে যাবার সময় মৌলভী আবদুস সাত্তার নেওলাপুরী ঘটনাটি দেখতে পায়। নেওলাপুরী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমেনার বিচারের জন্যে আদালতের শরণাপন্ন হয়। সেই বিচার অনুষ্ঠানই এ নাটকের বিষয়বস্তু।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামী আমেনা। গ্রাম্য মেয়ে, বয়স পঁচিশ–ছাব্বিশ। পরনে শাদা শাড়ি। মাথায় কপাল পর্যন্ত ঘোমটা, দৃষ্টি অবনত। পর্দা ওঠলে দেখা যাবে বিচারকের আসনে জজ নিন্দ্রাচ্ছন্ন। মাথা পেছনের দিকে হেলানো, মুখটা কিছু খোলা। বয়স পঞ্চাশের ওপর।
‘সমগ্র মঞ্চ নিস্তব্ধ। সে নিস্তব্ধতার মধ্যে কেবল জজের উচ্চ নাসিকা ধ্বনি শোনা যায়।’
এভাবেই বিচারলয়ের দৃশ্য দেখিয়েছেন নাট্যকার। সেখানে আসামী ফরিয়াদি দর্শক শ্রোতা ও কর্মচারীবৃন্দ রয়েছে কিন্তু বিচারক নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন।’ বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলেও নাটকের জন্য এটাই স্বাভাবিক। আদালতের সকলেই অপেক্ষমাণ চাপরাশীর জন্যে, সে জজ সাহেবের বাসায় গিয়েছে চশমা নিয়ে আসতে এবং চশমা এসে পড়লেই তিনি আমেনার বিচারের রায় পাঠ করবেন। নাটকের শেষে চশমার প্রসঙ্গটিও যেন প্রতীকী হয়ে ওঠে। চশমা আসার পর ‘জজ সাহেব হাতুড়ি পেটান, তাঁর দৃষ্টি টেবিলে রাখা অদৃশ্য রায়ের ওপর।’ এখানেই নাটকের সমাপ্তি।
বাংলা নাট্য সাহিত্যে তরঙ্গ–ভঙ্গর অনন্যতা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্র রূপক নাট্যাবলীর সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর তরঙ্গ–ভঙ্গর ব্যবধান মূলত জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গির। প্রকৃতির নির্মমতার কাছে মানবসত্তার অসহায়ত্ব রবীন্দ্রনাথকে বিচলিত করেছিল, আর ওয়ালী উল্লাহকে দগ্ধ করেছিল সামাজিক ও মানবিক নিয়ম কানুন আচার অনুষ্ঠানের কাছে মানব অস্তিত্বের অসহায়তা ও সমস্যা। সমাজের প্রাচীন ও পচে যাওয়া রীতিনীতিকে প্রায়শই ব্যঙ্গ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন ওয়ালীউল্লাহ। তিনি তাঁর স্বসমাজের মানুষের সীমাহীন দুঃখ দেখেছেন এবং সেই দুঃখসমূহের কোনো কোনোটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশও করেছেন।
মিথ্যার মোড়ক থেকে সত্যকে বাস্তবতাতে মোচন করাই বিচারকের দায়িত্ব শিল্পীরও কাজ। ন্যায়–অন্যায়, সত্যমিথ্যা, ভালো মন্দ অর্থাৎ সার্বিকভাবে নৈতিকতার প্রশ্ন মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তরঙ্গ–ভঙ্গতে ওয়ালীউল্লাহ উচ্চতর মানবিক উপলদ্ধিকে রূপায়িত করতে চেয়েছেন। প্রথাগত সমাজ–চেতনায় সবচেয়ে বেশি প্রকাশ ঘটেছে। লালসালু, বহিপীর এবং তরঙ্গভঙ্গ উপন্যাসও নাটক দুটিতে। সমাজের বহির্লোক এবং ব্যক্তির অন্তর্লোক বিম্বিত হয়েছে এইসব শিল্প কর্মে।
দার্শনিকের মতো ওয়ালীউল্লাহরও জীবনের দিকে সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে জীবন ও মৃত্যু যৌথভাবে তাঁর ভিতরে দেখা দিয়েছিলো সত্যরূপে। তবে মৃত্যু চেতনায়ই আচ্ছন্ন ছিলো তাঁর চেতনা। এ চেতনা রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও খুব বেশি লক্ষণীয়। তাঁর সমগ্র সাহিত্যের মৃত্যুর প্রবল উপস্থিতি। তাঁর জীবন ও মৃত্যুর দর্শনঃ জীবন মৃত্যু দু’টিই সে অতি সহজে গ্রহণ করে। আলো–অন্ধকারের মতো জীবন এবং মৃত্যু পাশাপাশি বসবাস করে। একই নদীতে মিলিত দু’টি ধারার মতো গলাগলি হয়ে প্রবাহিত হয়, দু’টিই বিনা বাক্যে গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় তার কাছে।
(কাঁদো নদী কাঁদো)
‘নক্ষত্রখচিত কালো রাত’ তাঁর প্রিয়প্রতীক জীবনের বিপরীতে মৃত্যু এবং শূন্যতারই প্রতীক।
এই তো সেই অন্ধকার, কাজল কালো আদিম অন্ধকার। এ অন্ধকারে কী শান্তি! তার গহ্বরে যে অন্ধ জীবন তার যাত্রা নেই, শুরু নেই, সেখানে প্রশ্ন নেই, ভয় নেই, আশা নেই, নিরাশা নেই।
(তরঙ্গভঙ্গ)
তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি আমার আঁকা ছবিতে সে সমাজকে প্রতিফলিত করতে চাই, যাতে তারা নিজের সুষ্ঠু চেহারা দেখবার সুযোগ পায়।


