কক্সবাজারের নাজিরার টেকে প্রায় ১০০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বিশাল শুঁটকি পল্লী। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ পল্লীর প্রায় ২০ হাজার বসবাসকারীর পেশা শুঁটকিকে কেন্দ্র করে। বণিকবার্তায় প্রকাশিত রাইমন মোহাম্মদের লেখাটি এখানে তুলে দেয়া হলঃ
পানির ক্ষীণ নালার দুই পাশে পতিত জমিতে থিকথিকে কাদায় শামুক-ঝিনুকের পসরা। সেই শামুক-ঝিনুকের আসরে রসনা তৃপ্তির জন্য ভিড় করেছে গাংচিল আর কাদাখোঁচার দল। ছোট লাল কাঁকড়ার মিছিল দূর থেকেই দেখতে হয়, কাছে গেলেই স্যাঁত করে পালাবে তার নিরাপত্তাঘরে। ভাটার টানে ডাঙ্গায় আটকে থাকা সাম্পান। ব্যাপার কী, এত গাংচিল কেন, শত শত গাংচিল এদিক ওদিক যাচ্ছে, আবার কোথাও বসে পড়ছে। ধবল রঙের স্রোত যেন। গাংচিল বা এলবাট্রসের আনাগোনা দেখে এটা সহজেই অনুমেয় যে পোতাশ্রয় কাছেই। বিদেশী গল্পে এমনটাই লেখা থাকে। কত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কাদা মাড়িয়ে অটোরিকশা নিয়ে চলেছে শুঁটকিপল্লীর পানে। অবশেষে বোঝা গেল গাংচিল ওড়ার কারণ। পোতাশ্রয় নয় এখানে, শুঁটকির টানে এসেছে গাংচিল। অটোরিকশা প্রবেশ করল নাজিরহাট গ্রামে। যতখানি চোখ যায় শুধু মাছ শুকানোর বাঁশের মাচান, লম্বামাচা -খাড়ামাচা। ডানে-বামে, সামনে-পিছনে সর্বত্র চোখে পড়ছে মাছ শুকানোর দৃশ্য। ছবির মতো কেউ বাঁশের খাঁচিতে করে মাছ নিয়ে আসছে। কেউ বসে সেই মাছ শ্রেণী অনুযায়ী আলাদা করছে। কেউ বড় মাছগুলোর পেট কেটে নাড়ি-ভুঁড়ি ফেলে দেয়ার কাজ করছে। কোথাও শুঁটকি বস্তায় ভরা হচ্ছে, কোথাওবা গাড়িতে তোলা হচ্ছে। কারো ফুরসত্ নেই। যেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞে নেমেছে নাজিরার টেকবাসী। আমাদের গন্তব্য নাজিরার টেকের শেষ মাথা। পথে চায়ের দোকান চোখে পড়তেই নেমে পড়লাম। গোটা দশেক লোক আছে দোকানে। চায়ের সঙ্গে ডালপুরি আছে। দোকানে টেলিভিশনে বিটিভির খবর দেখার এক পর্যায়ে দেখি কেউ আর খবর দেখছে না। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। ডালপুরি মুখে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। পরে একজন এসে বলল, ‘আপনার মতো একজনকে টিভিতে দেখলাম।’ এবার বুঝলাম, আজকে তো আমার একটা নিউজ আছে। যত তাড়াতাড়ি ফুটুস মারা যায়। দে ভোঁ দৌড়। অটোরিকশায় উঠে বসলাম। অটোরিকশাওয়ালার কাছে জানতে চাইলে সে বলল, এখানে রূপচান্দা, ছুরি, লাক্কা, কোরাল, সুরমা, কাচকি, চিংড়ি, মলা, লইট্ট্যা, গইন্যা, ফাইস্যাসহ প্রায় ২০ প্রজাতির মাছ শুকানোর কাজ চলে দিনমান।
অবশেষে শুঁটকির সারি পার হয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম গ্রামের শেষ মাথায়। কয়েকটা হোটেল পাওয়া গেল, খাবারের তেমন কিছু নেই। সূর্য দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে কিছুটা হেলে পড়েছে। শরীর বলছে তার চাহিদার কথা। ঘুরতে ঘুরতে একটা মুলিবাঁশের ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আহ! নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে একটা সুন্দর মাংস-তরকারির গন্ধ। ভিতরে কথা হলো হালিম মিয়ার সঙ্গে। রসনা তৃপ্ত হতে হতে গল্প জমে যায় হালিম মিয়ার সঙ্গে। বরিশালে বাড়ি তার। সেখানে বৌ ও দুই ছেলে, এক মেয়ে থাকে। একটা হোটেলে কাজ করতেন ঢাকার সদরঘাটে। সেই সুনাম হাতে নিয়ে শুরু করেছেন এই হোটেল। আট মাস হয় এখানে এসে ডেরা পেতেছেন। একা থাকার দৈন্য ঘুচাতে বিয়ে করেছেন এখানে আরেকটা। গরুর মাংসের সঙ্গে ভাত দুমুঠো, ক্ষিদের পেটে অমৃত যেন। হালিম মিয়ার কাছ থেকে জানা গেল, এখানে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষেরই আদিবাস মহেশখালী। এখানে অপরাধীও আছে অনেক, যারা অপরাধ করে পালিয়ে আসে। আপনিও কি তেমন কিছু করে এখানে এসেছেন? একটু চমকে উঠলেন যেন হালিম। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, ঘাট কোন দিকে?
ঘাটের পাশের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি। সারি সারি জাল রোদে শুকানো হচ্ছে। দু-একটা টাটা-ফুটা থাকলে পরম যত্নে সারাই করে নিচ্ছেন সমুদ্রের সন্তান মানুষগুলো। কালকেই সমুদ্রে সাম্পান ভাসাবেন জলিল মহাজন। চলছে শেষ পর্যায়ের জালের পরিচর্যা, নৌকা প্রস্তুত। এবার সমুদ্রে থাকবেন সাতদিন। কে জানে বিধিবাম হলে বেশিও থাকতে হতে পারে। আবার এমনো হতে পারে এই সমতটে আর ফেরাই হলো না। কোনো শুভ সকাল দেখে আরো কয়েক মাছ শিকারিসহ পাড়ি জমান সাগর পানে। প্রতিদিন ছোট নৌকায় করে মাছ আসতে থাকে ঘাটে। তারা থাকেন যত দিন মাছ পাওয়া যায় আর শরীরে কুলায়। এ শুঁটকি মহালকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে বলে জানা গেল। প্রায় ৮০০ ব্যবসায়ীসহ ২০-২৪ হাজার শ্রমিক এ কাজে নিয়োজিত। মৌসুমে শুঁটকি শুকানোর কাজে বাইরে থেকে অতিরিক্ত শ্রমিক এসে কাজে যোগ দেন। কক্সবাজার পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত নাজিরার টেক সংলগ্ন ঝিলংঝা ইউনিয়নে স্থায়ী বাসিন্দা প্রায় তিন হাজার। এদের সবাই কোনো না কোনোভাবে শুঁটকি ব্যবসায় জড়িত। নিয়ামত আলীর বসতি ছিল মহেশখালী। প্রায় বছর দশেক হয় এখানে এসে বসতি পেতেছেন। তার কাজ মাছ ধরা। স্ত্রী হনুফা মহাজনের মাছ বাছাইয়ের কাজ করেন। বড় ছেলে মাছ নামানোর কাজ আর ছোট ছেলে মহাজনের মাচা পাহারা দেয়। প্রতিটা পরিবারের অবস্থা প্রায় একই রকম।
মাছ ধরা শেষে ঘাটে এসে মাছ ভর্তি নৌকা ভিড়ে কিংবা ছোট নৌকা দিয়ে মাছ নিয়ে আসা হয়। গাংচিল আর মানুষের মেলা বসে যায় ঘাটে। ছোটরা শুশুক আর অক্টোপাসের মতো খেলার উপযোগী কিছু খুঁজতে থাকে। বড়রা হিসাব কষে কত মাছ হলো, পাইকাররা দাম-দর করতে থাকেন। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। বাঁশের খাঁচিতে করে সেই মাছ নামানো হয়। মাছগুলো চাটাইয়ে রেখে প্রকারভেদে আলাদা করা হয়। এর পর কোনো কোনো মাছে লবণ দিতে হয়। কোনো কোনো বড় মাছ কেটে কয়েক ভাগ করে তারপর শুকানো হয়। আবার কোনোটা সরাসরি শুকাতে দেয়া হয়। তবে কেউ কেউ শুকানোর সুবিধার জন্য কেমিক্যাল দিয়ে রেখে দেন দু-একদিন, যা পরিবেশ ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। নাজিরার টেকের বুক চিড়ে যে ছোট ছোট পানির নালা বয়ে গেছে, সেই সব নালার পানি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে এই কেমিক্যালের কারণে। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি- এই কয়মাস শুঁটকি বেশি পরিমাণ উত্পাদিত হয়। শুঁটকি শুকানোর একমাত্র অবলম্বন তীব্র রোদ। শুঁটকি শুকানোতে বেশি অংশ নেন নারীরা। বাঁশ দিয়ে তৈরি শত শত মাচা বা চাতালে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে শুকাতে দেয়া হয় শুঁটকিগুলো। মনোহর লইট্টা শুকানোর দৃশ্য দৃষ্টিনন্দন। তবে এখানে শিকার নিষিদ্ধ শার্ক মাছসহ অনেক সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণী চোখে পড়ল, যা এখনি বন্ধ করা উচিত।
নাজিরার টেকের পথে হাটছিলাম গোলাপ পাগলা প্রথম থেকেই আমাদের পিছু নিয়েছে। নাম জানতে চাইলে হাসিমুখে বলে দিলেন। এখানে নিয়মের বাইরে কী কী হচ্ছে— জানতে চাইলে সে বলে, ‘কত কিছুই তো নিষিদ্ধ। মানুষ কি তা মানে? আমাগো কেন চাপায় দিতে চান নিষিদ্ধের নিয়ম।’ হক কথা। তো আপনি কী করেন? ‘আমি তো এ জায়গার মালিক, মালিক বুঝেন? প্রেসিডেন্ট।’ একটা ভিজিটিং কার্ড ও কলম চেয়ে নিল। তার উল্টা পিঠে হিজিবিজি কী সব এঁকে কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ফোন করবেন, নাম্বার দেয়া আছে। যাই অনেক কাজ।’
প্রেসিডেন্টকে পাশ কাটিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়াই। স্তূপ করা শুঁটকি বাছাই করছেন কয়েকজন নারী। শুকানোর পর আবার আরেকবার বাছাই করা হয় শুঁটকিগুলো। পচা কিংবা ভাঙা শুঁটকি আগেই আলাদা করে রাখা হয়। এছাড়া নাম না জানা খাওয়ার অনুপযোগী সামুদ্রিক প্রাণী শুকানো হচ্ছে কোথাও কোথাও। পোলট্রি ফিড ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে নিয়ে যাবে। দেশের বিভিন্ন এলাকার পোলট্রি ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে রাখেন বাতিল বা খাওয়ার অনুপযোগী এ শুঁটকির জন্য। অনেকে মনে করেন, এই পোলট্রি ফিডের কাঁচামাল জোগান দিতে দেদার সাগরের প্রাণী মারা পড়ছে। সাগরের প্রাণী বাঁচিয়ে রাখতে, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই পোলট্রি ফিডে শুঁটকির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মনে করেন প্রকৃতিবিদরা। শুকানোর পর শুঁটকিগুলো প্লাস্টিকের বস্তায় ওজন দিয়ে ভরে রেখে দেয়া হয়। দৈনিক ডজন খানেক ট্রাক বোঝাই শুঁটকি দেশ-বিদেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়, যার পরিমাণ প্রায় শত টন। কক্সবাজারের খুরুশকুল, সমিতিপাড়া, নুনিয়ারছঠা, চৌফলদণ্ডি, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম এলাকায় শুঁটকিপল্লী রয়েছে। তবে দেশের সিংহভাগ শুঁটকির প্রয়োজন মেটায় নাজিরারটেক। এখানে উত্পাদিত শুঁটকি দেশে তো বটেই সৌদি আরব, হংকংসহ বেশ কয়েকটি দেশে রফতানি হয়। এক সমীক্ষায় জানা যায়, সেই স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে এখানকার শুঁটকি রফতানি হয়ে আসছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের শুঁটকির রফতানি আয় ছিল ৬১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই শুঁটকি রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি টাকার উপরে। অনেকে মনে করেন, শুধু শুঁটকি রফতানি করেই সরকার বছরে ১০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে। আর দাঁড়িয়ে যেতে পারে একটি শিল্প।
সমুদ্রতীরবর্তী বসতি হওয়ার কারণেই হয়তো চট্টগ্রামের খাবার-দাবারের একটা বিরাট অংশজুড়ে আছে শুঁটকি। অদ্ভুত ধরনের নাম আর নানা স্বাদের রান্না হয় এসব শুঁটকি দিয়ে। একবার দুই বন্ধু চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়ে হোটেলে খাবারের মেনু জানতে চাইলেন। বেয়ারা গড় গড় করে বলে গেলেন কয়েক প্রকারের খাবারের নাম। এর মধ্যে একটা নাম বেশ মনে ধরল দুই বন্ধুর। দুজন পরামর্শ করে পছন্দের ফাইস্যার অর্ডার দিলেন। এক বাটি শুকনো মাছের গুঁড়া এনে রাখা হলো সামনে। দেখেই ভড়কে গেলেন, খেতে গিয়ে পড়লেন মহাবিপাকে। এত গন্ধওয়ালা আর শক্ত জিনিসটা খায় কীভাবে। অথচ চট্টগ্রামের লোকদের কাছে এটা প্রিয় খাবার। চাইনিজ আর পর্তুগিজদের মধ্যে শুঁটকি খাওয়ার বেশ প্রচলন আছে। তবে তাজা মাছের তুলনায় শুঁটকিতে খনিজ লবণের পরিমাণ অনেক বেশি। ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ফেরাস, আয়রন প্রচুর পরিমাণে থাকে শুঁটকি মাছে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছের শুঁটকিতে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ পাওয়া যায়। শুঁটকিতে আছে প্রচুর প্রোটিন আর প্রায় সব ধরনের অ্যামাইনো এসিড। ১০০ গ্রাম শুঁটকিতে ১৪-২২ শতাংশই প্রোটিন। প্রতি ১০০ গ্রাম মাছে শতকরা দুই ভাগের নিচে চর্বি থাকলে তাকে কম চর্বিযুক্ত মাছ বলা হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের উত্পাদিত অধিকাংশ শুঁটকি কম চর্বিযুক্ত। তাই উচ্চরক্তচাপ বা হূদরোগে যারা ভুগছেন, তাদের জন্য শুঁটকি হতে পারে উত্কৃষ্ট খাবার।